সমস্ত লেখাগুলি

নক্ষত্রদের ঘূর্ণন -
সরোজ নাগ
Nov. 25, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:898 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যখনই আপনি গভীর মহাবিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দিকে তাকান, তখনই আপনি দেখতে পান অজস্র আলোর বিন্দু। আপনি জানেন সেগুলো হলো নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সি। সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে বৃহদাকার নক্ষত্রগুলির আয়ুষ্কাল সবচেয়ে কম। কারণ তারা তাদের চেয়ে কম ভরের নক্ষত্রদের তুলনায় অনেক দ্রুত তাদের জ্বালানিকে পুড়িয়ে দেয়। একবার তারা জ্বালানির সীমায় পৌঁছে গেলে এবং উপাদানগুলিকে আর ফিউজ করতে না পারলে, তারা তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং তারা হয়ে যায় নক্ষত্রের মৃতদেহ।


এই মৃতদেহগুলি একাধিক প্রকারের দেখা যায়। সর্বনিম্ন ভরের (যেমন, সূর্যের মতো) নক্ষত্রের জন্য শ্বেত বামন, পরবর্তী স্তরের জন্য নিউট্রন নক্ষত্র এবং সর্বাপেক্ষা বিশাল নক্ষত্রের জন্য ব্ল্যাক হোল। প্রতিটি মৃতদেহ নিজের অক্ষের চারপাশে তীব্র বেগে ঘুরতে থাকে। কিন্তু ব্ল্যাক হোলগুলি ঘোরে প্রায় আলোর গতিতে।

আমাদের সূর্য তার নিজের অক্ষের চারপাশে একবার আবর্তন করতে গড়ে প্রায় 27 দিন সময় নেয় (সূর্যের নিরক্ষরেখার কাছে প্রায় 25 দিন এবং মেরুবলয়ের কাছে এই সময়সীমা প্রায় 35 দিন)। অন্য দিকে একটি শ্বেত বামন নক্ষত্র একটি সম্পূর্ণ 360° ঘূর্ণন এক ঘন্টার কম সময়ে সম্পন্ন করে। এটি উদ্ভট মনে হতে পারে, কিন্তু আপনি যদি কখনও ফিগার স্কেটিং দেখে থাকেন, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই এটা দেখেছেন যে একজন ঘূর্ণায়মান স্কেটার যখন তাঁর ছড়ানো হাত দুটি গুটিয়ে নেন তখন তাঁর ঘূর্ণন গতি বেড়ে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এটি হলো কৌণিক ভরবেগের সংরক্ষণের নিয়ম (law of conservation of angular momentum)।


কৌণিক ভরবেগ হল "একটি ভরের সাথে কতটা 'রোটেশনাল' এবং/অথবা 'অরবিটাল' গতি আছে?" আপনি যদি সেই বৃহদাকার বস্তুটিকে ফুলিয়ে দেন যাতে এর ভরের বিস্তার তার ঘূর্ণন কেন্দ্র থেকে দূরে থাকে, তাহলে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের জন্য এটিকে তার ঘূর্ণন গতিতে ধীরগতি করতে হবে। একইভাবে, যদি আপনি একটি বৃহদায়তন বস্তুকে সংকুচিত করেন, যাতে এর ভরের বেশির ভাগ তার অক্ষীয় ঘূর্ণনের কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে, তবে সেই বস্তুটিকে তার ঘূর্ণন গতি বাড়াতে হবে, প্রতি সেকেন্ডে আরও বেশি ঘূর্ণন ঘটাতে হবে। এইভাবে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত হয়।


যদি আপনি আমাদের সূর্যের মতো একটি নক্ষত্রকে তার ভর, আয়তন এবং ঘূর্ণন গতি সহ বিচার করেন এবং এটিকে পৃথিবীর আকারের আয়তনে সংকুচিত করেন, যা একটি শ্বেত বামনের একটি সাধারণ আকার, তাহলে কী ঘটবে? বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনি যদি অনুমান করেন যে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত আছে এবং সূর্য ও সূর্যের সংকুচিত সংস্করণ দুটিই আমরা গোলক হিসেবে ভেবে নিই তাহলে সত্যিই হিসাব করে বলা যায় কী ঘটবে। যদি আমরা ধরে নিই যে সূর্যের সম্পূর্ণটি প্রতি 35 দিনে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে এবং সূর্যের কেবলমাত্র ভিতরের কোরের 40% একটি শ্বেত বামন হয়ে যায়, তখন সেই সংকুচিত শ্বেত বামন হওয়া সূর্য মাত্র 25 মিনিটের মধ্যে একটি ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করবে।


সেই নক্ষত্রের অবশিষ্টাংশের ভরকে ঘূর্ণনের অক্ষের (axis of rotation) কাছাকাছি নিয়ে এলে তার ঘূর্ণন গতি অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। সাধারণভাবে দেখা যায় যদি আপনি একটি বস্তুর ঘূর্ণনের সাথে সাথে তার ব্যাসার্ধের পরিমাণ অর্ধেক করেন, তার ঘূর্ণন গতি চারটি ঘাত বা ফ্যাক্টর দ্বারা বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণন গতি একটি ঘূর্ণমান ভরের ব্যাসার্ধের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক (inversely proportional)। বাস্তবে, শ্বেত বামনগুলি সাধারণত একটু বেশি ধীরে ঘোরে, কারণ নক্ষত্রের বাইরের স্তরগুলি উড়ে যায় এবং শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ "কোর" উপাদানগুলি একটি সাদা বামন গঠিত হওয়ার জন্য সংকুচিত হয়।


একটি নিউট্রন তারকা সাধারণত অনেক বেশি বড়ো নক্ষত্রের সুপারনোভাতে বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ার পর পড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ। এর কেন্দ্রের কণাগুলো অত্যাধিক চাপের ফলে এত সংকুচিত হয় যে এটি প্রায় একচেটিয়াভাবে (90% বা তার বেশি) নিউট্রন দিয়ে গঠিত একটি দৈত্যাকার পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মতো আচরণ করে। নিউট্রন নক্ষত্রগুলি সাধারণত গড়ে আমাদের সূর্যের ভরের দেড় গুণ থেকে দ্বিগুণের মধ্যে। তবে সেই পরিমাণ ভর মাত্র 10 থেকে 40 কিমি ব্যাসার্ধ্য বিশিষ্ট গোলকের মধ্যে আবদ্ধ। নিউট্রন নক্ষত্রগুলি যেকোনো সাধারণ তারকা বা শ্বেত বামনের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত ঘোরে।


আপনি যদি পুরো সূর্যকে একটি ছোট আয়তনে সংকুচিত করার পরীক্ষাটি পুনরাবৃত্তি করেন, কিন্তু এইবার মাত্র 40 কিলোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট সংকুচিত আয়তনে নিয়ে আসেন তাহলে আপনি শ্বেত বামনের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুত হারে ঘূর্ণন পাবেন। সেই পরিমাপটি হলো প্রায় 10 মিলিসেকেন্ড! কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণ সম্পর্কে আমরা পূর্বে ফিগার স্কেটারের যে নীতিটি প্রয়োগ করেছিলাম, সেই একই নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্তে আসা যায় যে নিউট্রন নক্ষত্র এক সেকেন্ডে 100 টিরও বেশি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করতে পারে।


প্রকৃতপক্ষে, এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের প্রকৃত পর্যবেক্ষণের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। কিছু নিউট্রন তারকা পৃথিবীর দৃষ্টিরেখা বরাবর রেডিও পালস নির্গত করে, সেগুলোকে পালসার বলা হয়। আমরা এই বস্তুর পালস পিরিয়ড পরিমাপ করতে পারি। দেখা যায় তাদের মধ্যে কয়েকটি তারকা একটি ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করতে প্রায় এক সেকেন্ড সময় নেয়, তাদের মধ্যে কিছু 1.3 মিলিসেকেন্ডের মতো কম, সর্বাধিক 716 ঘূর্ণন-প্রতি-সেকেন্ড (rotations-per-second) পর্যন্ত ঘোরে। সর্বাধিক হারে ঘূর্ণিত পালসারের নাম হলো PSR J1748−2446ad, এটি 2004 সালে আবিষ্কৃত হয়েছিলো।


সবচেয়ে দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারাগুলিকে মিলিসেকেন্ড পালসার বলা হয় এবং তারা সত্যিই অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত গতিতে ঘোরে। তাদের বাইরের পৃষ্ঠে এই ঘূর্ণন হারগুলি প্রকৃতপক্ষে রিলেটিভিস্টিক (relativistic)। যার অর্থ তারা আলোর গতির একটি উল্লেখযোগ্য ভগ্নাংশ নিয়ে গতিশীল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেই গতি শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির 50% এর বেশি গতিতে পৌঁছাতে পারে!


কিন্তু এটি মহাবিশ্বে পাওয়া সত্যিকারের অ্যাস্ট্রোফিজিকাল সীমার কাছেও যায় না। নিউট্রন তারা মহাবিশ্বের ঘনতম বস্তু নয়, সেই সম্মানটি ব্ল্যাক হোলের প্রাপ্য। সেটি নক্ষত্রের সমস্ত ভরকে মহাকাশের এমন একটি অঞ্চলে সংকুচিত করে (সিঙ্গুলারিটি!) যার ফলে আলোর গতিতে চলমান একটি বস্তুও সেখান থেকে পালাতে পারে না। 


আপনি যদি সূর্যকে প্রায় মাত্র 3 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি আয়তনে সংকুচিত করেন, তাহলে এটি একটি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। এই মাপকে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ (Schwarzschild radius) বলে যা নক্ষত্রের ভরের উপর নির্ভর করে। স্থান-কালের ফ্যাব্রিককে এই ব্ল্যাক হোল এতো বিকৃত করে যে ব্ল্যাক হোলের শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের বাইরেও অতিরিক্ত frame-dragging এর প্রভাব অনুভূত হয়। প্রকৃতপক্ষে যত বেশি আপনি সেই ভরকে সংকুচিত করবেন, স্থানের (এবং সময়েরও) ফ্যাব্রিকটি তত দ্রুত টেনে আনা হবে।


বাস্তবিকভাবে আমরা একটি ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে স্থানের ফ্রেম-টেনে নেওয়ার পরিমাপ করতে পারি না। কিন্তু আমরা সেই স্থানের মধ্যে উপস্থিত থাকা বস্তুর উপর ফ্রেম-ড্র্যাগিং প্রভাব পরিমাপ করতে পারি। এর অর্থ হল পদার্থ সমৃদ্ধ পরিবেশে বিদ্যমান এই ব্ল্যাক হোলের চারপাশে পাওয়া অ্যাক্রিশন ডিস্ক (accretion disk) এবং তার প্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করা।


তাই এগুলো এই ফ্রেম ড্র্যাগিং প্রভাবগুলি পরীক্ষা করার জন্য সেরা পরীক্ষাগার তৈরি করবে। সত্যিই এমন একটা পরীক্ষাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তা হলো গ্যালাক্সি NGC-1365 -এর কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল (যা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দ্বারা চিত্রিত প্রথম ছায়াপথগুলির মধ্যে একটি)। এটির বাইরের অঞ্চল থেকে নির্গত বিকিরণ সনাক্ত করা হয়েছে। তাকে পরিমাপ করে তার গতিও নির্ণয় করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন উপাদানগুলি শূন্য মাধ্যমে আলোর গতির প্রায় 84% গতিতে ঘোরে এবং তাঁরা মনে করেন অবশ্যই এর মধ্যে কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণের প্রভাব বর্তমান।


পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা LIGO (Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory) এবং Virgo-এর মতো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মহাবিশ্বে একত্রিত হওয়া ব্ল্যাক হোলগুলির ঘূর্ণনের অনুমান করেছেন। তাঁরা নির্ণয় করেছেন কিছু ব্ল্যাক হোল প্রায় 95% আলোর গতিতে ঘোরে। এটি তাত্ত্বিক ভাবে সর্বাধিক পরিমাপ। যে নক্ষত্রগুলি থেকে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয় সেগুলি অত্যন্ত ধীর গতিতে ঘোরে। অন্য দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন ব্ল্যাক হোলগুলিকে প্রায় আলোর গতিতে ঘুরতে হবে।


আপনি যদি মহাকাশে বস্তুকে সংকুচিত করে খুব ছোট করেন, তাহলে সেই বস্তুগুলোর অন্য কোনো বিকল্প নেই। যদি কৌণিক ভরবেগকে সংরক্ষণ করতে হয়, তবে তাদের ঘূর্ণন গতি বাড়াতেই হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রায় আলোর গতিতে পৌঁছায়। সেই মুহুর্তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হস্তক্ষেপ করবে এবং সেই শক্তির কিছু (এবং কৌণিক ভরবেগ) বিকিরিত হয়ে যাবে তার ফলে এটিকে তাত্ত্বিক সর্বোচ্চ মানের নীচে ফিরিয়ে আনবে। এই মহাবিশ্বে ব্ল্যাক হোলের অসাধারন গতিতে ঘোরার কোনো বিকল্প নেই। হয়তো কোনো দিন আমরা সরাসরি তাদের ঘূর্ণন পরিমাপ করতে সক্ষম হব।

চিত্র পরিচিতি (প্রথম ছবিটি) – The barred spiral galaxy NGC 1365. সৌজন্যে NASA/JPL Caltech/Judy Schmidt.

তথ্যসূত্র –

 (১) Evidence from K2 for Rapid Rotation in the Descendant of an Intermediate-mass Star. J. J. Hermes et al 2017. The Astrophysical Journal Letters, Vol 841, No 1

(২) Hessels, J. W. T.; Ransom, S. M.; Stairs, I. H.; Freire, P. C.; Kaspi, V. M.; Camilo, F. (2006). "A Radio Pulsar Spinning at 716 Hz". Science. 311 (5769)

(৩) LIGO Caltech, MIT.

(৪) NASA ও Wikipedia.

পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ২০২২ -
সরোজ নাগ
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র জগৎ সত্যিই রহস্যময়। আমরা জানি যে সেখানে কণাদের অস্তিত্ব রয়েছে। যখন সেই কণাগুলোকে পরিমাপ করা হয় তখন কণাগুলির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে একটি কোয়ান্টাম দশা (quantum state) পরিমাপ করতে গেলে তাদের আপনি যা পরিমাপ করবেন তা মৌলিকভাবে পরিবর্তিত (alter) বা নির্ধারিত (determine) হতে পারে। এমনকি দুটি কোয়ান্টাকে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করানোর ফলেও একই ঘটনা ঘটে। একজন পর্যবেক্ষকের ক্রিয়াকলাপ ছাড়া সেই অবজেক্টিভ বাস্তবতা কোনো মৌলিক উপায়ে বিদ্যমান বলে মনে হয় না। 

কিন্তু এর মানে এই নয় যে প্রকৃতি কোনো নিয়ম মেনে চলে না। এই নিয়মগুলি বিদ্যমান, যদি সেগুলি আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন এবং সাধারণ জ্ঞানের বিপরীতে (counterintuitive) হয়, তবুও সেগুলো রয়েছে। এমনকি দুটি এন্ট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কোয়ান্টাম দশাকে অবশ্যই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। 

এভাবেই কোয়ান্টাম জগতে এক নতুন বৈপ্লবিক ধারণার বিকাশ ঘটছে যার নাম quantum information science.

এই কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সিস্টেম, এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা ফোটন আর বেলের অসমতা লঙ্ঘনের (violation of Bell’s inequalities) অগ্রণী গবেষণার জন্য 2022 সালের পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তিনজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী জন ক্লজার (John F. Clauser), অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট (Alain Aspect) এবং অ্যান্টন জেইলিংগারকে (Anton Zeilinger) এই অতি সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

আমাদের কোয়ান্টাম বাস্তবতার অনির্দিষ্ট প্রকৃতিকে প্রকাশ করে এমন অনেক ধরণের পরীক্ষা আমরা করতে পারি। যেমন -

 একটি উপযুক্ত বাক্সে বেশ কয়েকটি তেজস্ক্রিয় পরমাণু রাখুন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। সেই সময় পরে গড়ে কতগুলি পরমাণু থাকবে আর কতগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, আপনি ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন। কিন্তু কোন পরমাণু টিকে থাকবে এবং থাকবে না তা আগে থেকে বলার কোনো উপায় আপনার কাছে নেই। আমরা শুধুমাত্র পরিসংখ্যানগত সম্ভাবনা খুঁজে পেতে পারি।


 বিখ্যাত double slit পরীক্ষায় সংকীর্ণ ব্যবধানযুক্ত দুটো ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে পরপর অনেকগুলো কণা নিক্ষেপ করলে পিছনে পর্দায় কী ধরণের interference প্যাটার্ন তৈরি হবে তা অনুমান করতে আপনি সক্ষম হবেন। প্রতিটি পৃথক কণার জন্য, এমনকি যখন একবারে একটি কণাকে স্লিটের মাধ্যমে পাঠানো হয়, আপনি কিছুতেই আগে থেকে নির্দিষ্ট করতে পারবেন না যে এটি কোথায় কোন ছিদ্র দিয়ে গিয়ে পর্দায় আঘাত করবে।


কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার কিছু দিক সম্পূর্ণ র‍্যান্ডম বলে মনে হয়। কিন্তু এগুলি কি সত্যিই র‍্যান্ডম, নাকি এই সিস্টেমগুলি সম্পর্কে আমাদের তথ্য সীমিত থাকার জন্য এগুলিকে কেবল র‍্যান্ডম দেখায়?

 আমাদের কাছে থাকা সেই তথ্যগুলো কি একটি অন্তর্নিহিত বাস্তবতা প্রকাশ করার জন্য অপর্যাপ্ত? কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূচনা থেকেই আইনস্টাইন থেকে বোর এবং তার পরেও বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে তর্ক করেছেন।

কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে বিজ্ঞানীরা কেবল যুক্তিতর্কের উপর ভিত্তি করে নয় বরং পরীক্ষানিরীক্ষার উপর ভিত্তি করে বিষয়গুলি নির্ধারণ করেন। আমরা যদি কোয়ান্টাম সিস্টেমের বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন নিয়মগুলি জানতে পারি তাহলে আমরা সেই সিস্টেমের প্রত্যাশিত, সম্ভাব্য আচরণটি নির্ণয় করতে পারি। এরপর পর্যাপ্ত পরিমাপে সেটআপ এবং যন্ত্রপাতি দেওয়া হলে, আমরা পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের ভবিষ্যৎবাণী পরীক্ষা করতে পারি এবং আমরা যা পর্যবেক্ষণ করি তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমরা সম্ভব হলে এমন একটি পরীক্ষাও ডিজাইন করতে পারি যা বাস্তবতা সম্পর্কে অত্যন্ত গভীর ধারণা পরীক্ষা করতে পারে। যেমন কোয়ান্টাম সিস্টেমের জন্য যতক্ষণ না তাদের পরিমাপ করা হয় তখন সেই সিস্টেমে কোনো মৌলিক অনিশ্চয়তা আছে কিনা অথবা আমাদের বাস্তবতার অন্তর্নিহিত কিছু "লুকানো ভেরিয়েবল" বা “hidden variable” আছে কি না যা পরিমাপ করার আগেই ফলাফল কী হতে চলেছে তা পূর্ব-নির্ধারণ করে।


এই ধরনের প্রশ্নগুলোর একটা সমাধান পাওয়া যেতে পারে একটি বিশেষ ধরনের কোয়ান্টাম সিস্টেমে, তা হলো একটি এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কোয়ান্টাম সিস্টেম। আপনাকে যা করতে হবে তা হল কণার একটি entangled জোড়া তৈরি করা, যেখানে একটি কণার কোয়ান্টাম দশা অন্যটির কোয়ান্টাম দশার সাথে সম্পর্কযুক্ত (correlated)। যদিও স্বতন্ত্রভাবে দেখলে, উভয়েরই সম্পূর্ণরূপে র‍্যান্ডম এবং অনির্দিষ্ট কোয়ান্টাম দশা রয়েছে, কিন্তু একসাথে হিসেবে নেওয়া হলে উভয় কোয়ান্টার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা উচিত।

এমনকি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্যও এই বিষয়টি অদ্ভুত বলে মনে হয়। সাধারণত আমরা জানি যে কোনো সংকেত তার তথ্য সমেত শূন্যস্থানে আলোর চেয়ে বেশি গতিতে যেতে পারে না। কিন্তু আপনি যদি -

একটি কণার একটি এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কণা তৈরী করেন

এবং তারপর তাদের খুব বেশি দূরত্বে পৃথক করে রাখেন

এবং তারপর তাদের একটির কোয়ান্টাম অবস্থা পরিমাপ করেন

তখন অন্যটির কোয়ান্টাম অবস্থা হঠাৎ করে নির্ধারিত হয়

আর সেই নির্ধারিত হওয়া আলোর গতিতে নয়, বরং তাৎক্ষণিকভাবে হয়!

এর আগে বিজ্ঞানীরা 33 কিমি দূরে অবস্থিত রুবিডিয়াম-87 পরমাণুর এনট্যাঙ্গল জোড়া তৈরী করে পরীক্ষা করেছিলেন। [তথ্যসূত্র - 1 দ্রষ্টব্য] এবং তাঁরা দেখেছিলেন যে এনট্যাঙ্গল ঘটনাটি সত্যিই সঙ্গে সঙ্গে ঘটে। তবে কি এই ঘটনা বিজ্ঞানের একটা মূলগত ধারণাকে নস্যাৎ করে? না। যদিও কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট দীর্ঘ দূরত্বে কণাগুলিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব পড়তে পারে, আমরা আলোর গতির চেয়ে দ্রুত তথ্য পরিবহন করতে এটিকে ব্যবহার করতে পারি না। শুধু এনট্যাঙ্গলমেন্ট নিজেই তথ্য পাঠানোর জন্য যথেষ্ট নয়। যেমন কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন দীর্ঘ দূরত্ব জুড়ে কোয়ান্টাম দশাকে স্থানান্তর করতে এনট্যাঙ্গলমেন্ট ব্যবহার করতে সক্ষম। এই টেলিপোর্টেশনের জন্য entangled qubits ছাড়াও একটি ক্লাসিক্যাল বিট পাঠানোর প্রয়োজন হয়। সুতরাং, এনট্যাঙ্গলমেন্ট তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করে, কিন্তু তথ্যের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া ক্লাসিক্যাল ইনফরমেশনের গতি দ্বারা সীমিত, যা আলোর গতিতে এগিয়ে চলে। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা যদিও এ সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। [তথ্যসূত্র - 2 দ্রষ্টব্য]

যাইহোক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট আমরা সাধারণ ভাবে যতটা ভাবি বাস্তবে অতোটাও সহজ নয়। যেমন যদি একটি কণাকে "স্পিন আপ" হিসাবে পরিমাপ করা হয়, তবে এর অর্থ এই নয় যে অন্যটি 100% সময়েই "স্পিন ডাউন" হবে। তার মানে হলো যে অন্যটি হয় "স্পিন আপ" বা "স্পিন ডাউন" হওয়ার সম্ভাবনা কিছু পরিসংখ্যানগত নির্ভুলতার সাথে ভবিষ্যৎ বাণী করা যেতে পারে। এটা নির্ভর করবে আপনার পরীক্ষার সেটআপের উপর। সেই সেটআপের উপর নির্ভর করে এনট্যাঙ্গলমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা দাঁড়াবে 50% এর বেশি, কিন্তু 100% এর কম।

এই অনিশ্চয়তাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 1960-এর দশকে জন স্টুয়ার্ট বেল এই ঘটনার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন। এবং তা থেকেই নির্ণয় করেছিলেন বিখ্যাত Bell’s inequality বা বেলের অসমতা। এই অসমতা নিশ্চিত করে যে দুটি এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কণার পরিমাপকৃত দশার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক (correlations) কখনই একটি নির্দিষ্ট মান অতিক্রম করতে পারে না। অথবা তা এভাবেও বলা যায় "local hidden variables" উপস্থিত থাকলে এই এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা দশার মধ্যে পরিমাপ করা পারস্পরিক সম্পর্ক কখনই একটি নির্দিষ্ট মান অতিক্রম করবে না।


এই ক্ষেত্রে "স্থানীয়" বা "local" বলতে স্থানীয়তার নীতি (principle of locality) বোঝায়। এই নীতি অনুযায়ী একটি কণা শুধুমাত্র তার ঠিক আশেপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এবং তার সাথে ফিজিক্যাল ক্ষেত্রের (fields) মাধ্যমে করা মিথস্ক্রিয়া (interactions) আলোর গতির চেয়ে বেশি দ্রুত গতিতে ঘটতে পারে না। আর Hidden variables হল কোয়ান্টাম কণা দ্বারা আবিষ্ট (possessed) কাল্পনিক বৈশিষ্ট্য, এমন বৈশিষ্ট্য যা সনাক্ত করা যায় না কিন্তু তবুও পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞানী বেল বলেছিলেন "যদি (একটি লুকানো ভেরিয়েবল তত্ত্ব) লোকাল হয় তবে এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে একমত হবে না, এবং যদি এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে একমত হয় তবে এটি লোকাল হবে না।"


তবে স্ট্যন্ডার্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্স কোনো hidden variables ছাড়াই এই বেলের অসমতা লঙ্ঘন করবে। যার ফলে সঠিক পরিস্থিতিতে বা সেট আপে সেই পারস্পরিক সম্পর্ক (correlations) আশাতীত ভাবে শক্তিশালী হবে। তার মানে এনট্যাঙ্গলমেন্টের শতকরা পরিমান অনেক বৃদ্ধি পাবে। বিজ্ঞানী বেল এই ভবিষ্যৎ বাণীই করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা অস্থায়ী (untestable) ছিলো।

এবং সেখানেই এই বছরের পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ীদের অসাধারণ অগ্রগতির প্রসঙ্গ আসে।

প্রথমে আসে জন ক্লজারের গবেষণা। ক্লজার যে ধরনের কাজ করেছিলেন তা তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা প্রায়শই খুব কম মূল্যায়ন করেন। তিনি বেলের গভীর কিন্তু অব্যবহারিক কাজগুলি নিয়েছিলেন এবং সেগুলিকে উন্নত করেছিলেন যাতে তাদের একটি ব্যবহারিক পরীক্ষা তৈরি করা যায়। তিনি কাজ করেছিলেন CHSH inequality নিয়ে যেখানে C অক্ষরটি তাঁরই নামানুসারে। এই অসমতা নিয়ে বিশদে না বললেও এটুকু বলা যায় এখানে একজন পর্যবেক্ষকের কাছে একজোড়া এনট্যাঙ্গল কণা থাকে। তাঁর কাছে দুটি আলাদা লম্ব দিকের একটিতে তাদের কণার স্পিন পরিমাপ করার চয়েস থাকে। 

যদি বাস্তবতা (reality) পর্যবেক্ষকের উপর নির্ভর না করে, তাহলে প্রতিটি পৃথক পরিমাপকে অবশ্যই অসমতা (inequality) মেনে চলতে হবে। যদি তা না হয় (যেমন স্ট্যান্ডার্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্স), সেই অসমতা লঙ্ঘন করা যেতে পারে।

ক্লজার তাঁর ছাত্র স্টুয়ার্ট ফ্রিডম্যানের সাথে পরীক্ষাটির ডিজাইন ও সম্পাদনা করেছিলেন। তিনি নির্ধারণ করেছিলেন যে এটি আসলে বেলের (এবং CHSH) অসমতা লঙ্ঘন করেছে। স্থানীয় লুকানো পরিবর্তনশীল তত্ত্বগুলি (Local hidden variable), আমাদের মহাবিশ্বের কোয়ান্টাম বাস্তবতার সাথে দ্বন্দ্ব দেখায়। এবং এটা সত্যিই একটি নোবেল-যোগ্য কৃতিত্ব!

কিন্তু বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন অবিরাম, অবিরত। কোনো পরীক্ষার অন্তর্গত কেবলমাত্র সেই অনুমানগুলি ছাড়া আর কি কোনো কিছু হওয়া সম্ভব নয়? এখনো কি কিছু বিশেষ ধরনের লুকানো পরিবর্তনশীল থাকা সম্ভব যা এখনও বিজ্ঞানী ক্লজারের পরিমাপ করা ফলাফলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে?

এই বছরের নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে দ্বিতীয় বিজ্ঞানী অ্যালাইন অ্যাসপেক্টের কাজটি এখানেই আসে৷ অ্যাসপেক্ট বুঝেছিলেন যে যদি দুটি পর্যবেক্ষক একে অপরের সাথে কার্যকারন যোগাযোগে (causal contact) থাকেন [অর্থাৎ, যদি তাঁদের একজন অন্যজনকে তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে আলোর গতিতে তথ্য পাঠাতে পারেন এবং অন্য পর্যবেক্ষক তাঁর ফলাফল পরিমাপ করার আগে সেই ফলাফলটি পেতে পারেন] তাহলে একজন পর্যবেক্ষকের পরিমাপের "পছন্দ" (choice) অন্যটির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

1980 এর দশকের গোড়ার দিকে, সহযোগী ফিলিপ গ্রেঞ্জিয়ার, জেরার্ড রজার এবং জিন ডালিবার্ডের সাথে অ্যাসপেক্ট বেশ কয়েকটি গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন যা অনেক ক্ষেত্রেই ক্লজারের কাজকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল। তিনি বেলের অসমতার লঙ্ঘনকে অনেক বেশি পরিমাপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি আগের আগের পরীক্ষাগুলিতে সর্বোচ্চ 55%-এর সীমায় বেলের অসমতার লঙ্ঘনের চেয়ে তাত্ত্বিক মতের 83% মাত্রার লঙ্ঘিত হওয়াকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর পরীক্ষার সেটআপে ব্যবহৃত প্রতিটি ফোটনের পোলারাইজারের orientation কে দ্রুত ও ক্রমাগত র‍্যান্ডম পরিবর্তন করে তিনি দেখিয়েছেন যে দুজন পর্যবেক্ষকের মধ্যে যেকোনও “stealth communication” আলোর গতির চেয়ে অনেক বেশি গতিতে ঘটা সম্ভব। [তথ্যসূত্র - 3 দ্রষ্টব্য]

সেই শেষ কৃতিত্বটি ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, পরীক্ষাটি এখন বিজ্ঞানীমহলে third Aspect experiment হিসেবে পরিচিত। বিজ্ঞানী অ্যাসপেক্ট যদি অন্য কিছু না-ও করতেন তবে শুধু এই লোকাল, বাস্তব লুকানো ভেরিয়েবলের (real hidden variables) সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অসঙ্গতি প্রদর্শন করার পরীক্ষাটিই তাঁকে খ্যাতি ও সম্মানের শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

কিন্তু তবুও বিজ্ঞানীরা আরও নিখুঁত লুপহোল বিহীন পরীক্ষা চেয়েছিলেন। এই সমবর্তন সেটিংস (polarization settings) কি সত্যিই র‍্যান্ডম বা এলোমেলোভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল নাকি সেগুলো pseudorandom ও হতে পারে? যেখানে হয়তো দুজন পর্যবেক্ষকের মধ্যে প্রেরিত কিছু অদেখা সংকেত আলোর গতিতে ভ্রমণ করতে পারে যা তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে (correlations) ব্যাখ্যা করে। 

সেই শেষোক্ত লুপ হোলকে সত্যিকার অর্থে বন্ধ করার একমাত্র উপায় হল দুটি এনট্যাঙ্গল হওয়া কণা তৈরি করা, তাদের জোড় বজায় রেখে খুব বড় দূরত্বে আলাদা করা এবং তারপরে একই সাথে যতটা সম্ভব কাছাকাছি তুলনামূলক পরিমাপ করা। এই ঘটনাটি বিখ্যাত আলোক শঙ্কুর (light-cones) বাইরে দুজন পৃথক পর্যবেক্ষককে রাখে। এর ফলে নিশ্চিত হয় যে দুটো আলাদা পরিমাপ কখনোই একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে না।

শুধুমাত্র যদি প্রতিটি পর্যবেক্ষকের পরিমাপ তাদের মধ্যে যোগাযোগের কোন সম্ভাবনা ছাড়াই (উপরে উল্লেখিত অদেখা সংকেত সহ) একে অপরের থেকে সত্যিকারের স্বাধীন হতে পারে তখনই বিজ্ঞানীরা লোকাল, বাস্তব লুকানো ভেরিয়েবলের চূড়ান্ত লুপ হোলটি বন্ধ করতে পারবেন। সেখানেই এই বছরের তৃতীয় নোবেল প্রাপক, অ্যান্টন জেইলিংগারের কাজটি কার্যকর হয়। [তথ্যসূত্র 4 দ্রষ্টব্য]

জেইলিংগার এবং তাঁর সহযোগীরা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার সাহায্যে কাজটি সম্পন্ন করেন। 

প্রথমত, তারা লেজারের আলোর সাথে একটি ডাউন-কনভার্সন ক্রিস্টাল পাম্প করে এক জোড়া এনট্যাঙ্গল হওয়া ফোটন তৈরি করেছিলেন।

 তারপরে, তারা ফোটন জোড়ার প্রতিটি সদস্যকে একটি পৃথক অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা কোয়ান্টাম দশাকে সংরক্ষণ করে প্রেরণ করেছিলেন।

 এর পরে, তারা দুটি ফোটনকে প্রাথমিকভাবে প্রায় 400 মিটার ব্যবধানে রেখেছিলেন। পরে তাদের আরও এমন দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে তাদের মধ্যে আলোর ভ্রমণের সময় এক মাইক্রোসেকেন্ডের চেয়ে দীর্ঘ হয়।

 এবং অবশেষে, তাঁরা প্রতিটি পরিমাপের মধ্যে দশ ন্যানোসেকেন্ডের ক্রম অনুসারে (দশ, একশো, এক হাজার এইভাবে) সময়ের পার্থক্য সহ পরীক্ষাটি সম্পাদনা করেছিলেন।

তাঁরা এই পরীক্ষাটি 10,000 বারের বেশি সম্পাদন করেছিলেন। তার ফলে এতো বেশি শক্তিশালী পরিসংখ্যান তৈরী হয়েছে যাতে সেই "অদৃশ্য সংকেত" (unseeable signal) টির লুপ হোল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে এর পরবর্তী অন্য পরীক্ষাগুলি দুটো এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা ফোটনের দূরত্বকে কয়েকশত কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ধীরে ধীরে আমাদের প্রযুক্তি এতো বেশি উন্নত হয়ে উঠছে যে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া একটা পরীক্ষাতে এনট্যাঙ্গল হয়ে থাকা একটি ফোটন ভূপৃষ্ঠে এবং অন্য ফোটনটি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মহাকাশে থেকে আমাদের চারিদিকে পাক খাচ্ছে! [তথ্যসূত্র 5 দ্রষ্টব্য]

বিজ্ঞানী জেইলিংগার আরও একটি বিখ্যাত পরীক্ষার সম্পাদনা করেছিলেন যাতে তিনি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে অদ্ভুত কোয়ান্টাম ঘটনাগুলির একটিকে সক্ষম করেছিল, তা হলো কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন। একটি বিখ্যাত কোয়ান্টাম নো-ক্লোনিং উপপাদ্য (quantum no-cloning theorem) রয়েছে, যা নির্দেশ করে যে আপনি মূল কোয়ান্টাম দশাকে ধ্বংস না করে একটি নির্বিচারে (arbitrary) কোয়ান্টাম দশার একটি অনুলিপি তৈরি করতে পারবেন না।

 বিজ্ঞানী Francesco De Martini এর গ্রুপের সাথে জেইলিংগারের গ্রুপ মিলেমিশে এনট্যাঙ্গেলমেন্ট অদলবদল করার একটি ঘটনা পরীক্ষামূলকভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই পরীক্ষাতে দেখা যায় একটি কণার সঙ্গে এনট্যাঙ্গেলমেন্টে জড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও অন্য একটি দ্বিতীয় কণার কোয়ান্টাম দশা কার্যকরভাবে একটি ভিন্ন তৃতীয় কণার মধ্যে "সরানো" যেতে পারে। যেখানে তৃতীয় কণাটির সাথে প্রথম কণাটির কোনো ভাবেই সরাসরি যোগাযোগ নেই! [তথ্যসূত্র - 6 দ্রষ্টব্য]

বস্তুত কোয়ান্টাম ক্লোনিং এখনও অসম্ভব, কারন মূল কণার কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্যগুলি সংরক্ষণ করা হয়নি। তবে সেই পরীক্ষাতে একটি কোয়ান্টাম সংস্করণ নিশ্চিতভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। যা অবশ্যই অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা নোবেল পাওয়ার যোগ্য।

এই বছরের নোবেল পুরস্কার কেবল একটি ফিজিক্যাল কৌতূহল নয়, যা আমাদের কোয়ান্টাম বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু গভীর সত্য উন্মোচন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। Clauser, Aspect, এবং Zeilinger-এর গবেষণার কারণে আমরা এখন বুঝতে পারি যে এনট্যাঙ্গলমেন্ট কণাগুলি কোয়ান্টাম রিসোর্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যা সেটিকে যথেষ্ট দীর্ঘ সময় জুড়ে ব্যবহারিক অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ব্যবহার করতে সক্ষম করে।

কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট অনেক বড় দূরত্বের উপর ঘটতে পারে, যা যথেষ্ট বড় দূরত্বে কোয়ান্টাম তথ্যের মাধ্যমে যোগাযোগের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। Quantum repeaters, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক উভয়ই এখন সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে পারে। এছাড়াও বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত (controlled) এনট্যাঙ্গলমেন্ট কেবল দুটি কণার মধ্যে নয়, অনেকগুলো কণার মধ্যে সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে condensed matter এবং multi-particle systems এর কথা বলা যায়। এবং এই প্রক্রিয়াগুলি চলবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভবিষ্যৎবাণীগুলির সাথে সঙ্গতি রেখে, লুকানো পরিবর্তনশীল তত্ত্বগুলির সাথে নয়। অবশেষে উল্লেখ করা যায় একটি বেল-অসমতা লঙ্ঘনকারী পরীক্ষা দ্বারা সংঘটিত কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির কথা, যা জেইলিঙ্গার নিজেই পরীক্ষাটি করেছিলেন।


2022 সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী জন ক্লজার, অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট এবং অ্যান্টন জেইলিংগারকে জানাই শ্রদ্ধা এবং আন্তরিক অভিনন্দন। 

তাঁদের জন্যই কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট আর কেবল একটি তাত্ত্বিক কৌতূহল নয়, বরং একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা আজকের প্রযুক্তির অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সরোজ নাগ 

চিত্র পরিচিতি -

চিত্র 1ঃ পদার্থবিজ্ঞানে 2022 সালের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী ত্রয়। বাম দিকে Anton Zeilinger, মাঝে John F. Clauser এবং ডান দিকে Alain Aspect. সৌজন্যে  CNN

তথ্য সূত্র --

1) van Leent, T., Bock, M., Fertig, F. et al. Entangling single atoms over 33 km telecom fibre. Nature 607, 69–73 (2022). https://doi.org/10.1038/s41586-022-04764-4

2) Basic Theory of Quantum Entanglement and the Possibility of Passing on Information Faster than the Speed of Light, Yihe Xue 2021 IOP Conf. Ser.: Earth Environ. Sci. 658 012001 https://iopscience.iop.org/.../10.../1755-1315/658/1/012001

3) Experimental Test of Bell's Inequalities Using Time-Varying Analyzers 

Alain Aspect, Jean Dalibard, and Gérard Roger, Phys. Rev. Lett. 49, 1804 – Published 20 December 1982 DOI:https://doi.org/10.1103/PhysRevLett.49.1804

4) Violation of Bell's Inequality under Strict Einstein Locality Conditions

Gregor Weihs, Thomas Jennewein, Christoph Simon, Harald Weinfurter, and Anton Zeilinger, Phys. Rev. Lett. 81, 5039 – Published 7 December 1998

DOI:https://doi.org/10.1103/PhysRevLett.81.5039

5) Entanglement demonstration on board a nano-satellite, Optica Vol. 7, Issue 7, pp. 734-737 (2020)

https://doi.org/10.1364/OPTICA.387306

6) Experimental Entanglement Swapping: Entangling Photons That Never Interacted, Jian-Wei Pan, Dik Bouwmeester, Harald Weinfurter, and Anton Zeilinger, Phys. Rev. Lett. 80, 3891 – Published 4 May 1998

DOI:https://doi.org/10.1103/PhysRevLett.80.3891 

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930